নিজস্ব প্রতিনিধি, ডায়মন্ড হারবার: ডায়মন্ড হারবারের স্টেশন মাস্টার খুনের ঘটনায় নতুন মোড় , পুলিশের তদন্তে উঠে এলো চাঞ্চল্যকর তথ্য “স্টেশন মাস্টার” স্বামীর চাকরি হাতিয়ে নতুন সংসার পাততে প্রেমিককে নিয়ে খুন করল স্ত্রী! দক্ষিণ ২৪ পরগণার ডায়মন্ড হারবারের রায়নগরে গত ১১ই নভেম্বর এক ব্যক্তির রক্তাক্ত মৃতদেহ উদ্ধার হয়। জানাগেছে, ঐ ব্যক্তির নাম নির্মল কুমার। তিনি ডায়মন্ড হারবারের অ্যাসিস্ট্যান্ট স্টেশন মাস্টারের পদে চাকরি করতেন। কার্যত বাড়ির সামনের একটি নর্দমার মধ্যে থেকেই উদ্ধার হয় ঐ ব্যক্তির মৃতদেহ। পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ঘটনার তদন্তে নামে।
নর্দমা থেকে মেলে ডায়মন্ড হারবারের স্টেশন মাস্টারের দেহ। সূত্র ধরে তদন্ত করে ওই খুনের কিনারা করল ডায়মন্ড হারবার পুলিশ। জানা গিয়েছে, স্বামীকে খুন করে তাঁর চাকরি হাতিয়ে প্রেমিকের নতুন ঘর বাঁধার পরিকল্পনা ছিল স্টেশন মাস্টারের স্ত্রীর। প্রেমিক-সহ পুলিশের জালে ধরা পড়ল ওই মহিলা।
গত সোমবার সকালে তাঁর বাড়ির পাশের নর্দমায় দেহ পড়ে থাকতে দেখেন স্থানীয়রা। এরপরই খবর দেওয়া হয় পুলিশে। নিহত ব্যক্তির নাম নির্মল কুমার। বিহারের বাসিন্দা তিনি। দীর্ঘদিন ধরেই ডায়মন্ড হারবারে ভাড়া বাড়িতে থাকতেন তিনি। জানা গিয়েছে, চলতি মাসের ৫ তারিখ বিহার থেকে ডায়মন্ড হারবারে এসেছিলেন নির্মলবাবুর স্ত্রী। তারপরই নির্মলবাবুর রহস্যমৃত্যুর ঘটনায় প্রশ্নের মুখে তাঁর স্ত্রীর ভূমিকা ছিল পুলিশের নজরে।
ময়না তদন্তের রিপোর্ট হাতে আসার পরই পুলিশের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে নির্মল কুমারকে খুন করা হয়েছে। পুলিশ নিহতের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে। তাতেই পরিষ্কার হয়ে যায় খুনের মোটিভ।
জেরায় নিহত নির্মল কুমারের স্ত্রী সোনালি জানিয়েছে, বিয়ের আগে থেকেই প্রেমিক আরশাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল তার। বিহার থেকে ডায়মন্ড হারবারে চলে এলেও আরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। স্বামী নির্মলকে খুন করে তাঁর চাকরি হাতিয়ে আরশাদের সঙ্গে সংসার করার পরিকল্পনা ছিল সোনালির। শনিবার রাতে প্রেমিক আরশাদকে ডায়মন্ড হারবারের বাড়িতে ডাকে সোনালি।
নিখুঁত পরিকল্পনা মাফিক ঘুরতে আসার নাম করে বিহার থেকে দেড় বছরের মেয়েকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে খুনের তিনদিন আগে ডায়মন্ড হারবারের ভাড়া বাড়িতে এসেছিল স্ত্রী সোনালি কুমারী। তিনদিনের মাথায় দক্ষিণ কলকাতার ইকবালপুরে ভগ্নিপতির বাড়িতে এসে ওঠে প্রেমিক ল্যাড্ডা ওরফে আরশাদ জলিল। কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। নিহত স্টেশন মাস্টার নির্মল কুমার সাহুকে খুনের অভিযোগে স্ত্রী সোনালি কুমারী ও তার প্রেমিক আরশাদকে শুক্রবার দুপুরে ডায়মন্ড হারবার এসিজেএম আদালতে তোলা হলে তাদের ১০ দিনের পুলিশ হেফাজতের নির্দেশ দেন বিচারক।
গত সোমবার বাড়ির কাছেই নর্দমায় মিলেছিল নির্মলের দেহ। সে দিন ছোট্ট মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন সোনালি। কিন্তু তার কথায় অসঙ্গতি থাকায় গোড়া থেকেই তাকে সন্দেহের তালিকায় রেখেছিল পুলিশ। ঘটনার পরে নির্মলের ভাই বিদ্যাসাগর সাহু ডায়মন্ড হারবার থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। অভিযুক্তের খোঁজ পেতে তদন্তে পুলিশ কুকুরও নামানো হয়েছিল। তদন্তের গতিবিধির উপর নজর রাখছিলেন ডায়মন্ড হারবারের এসডিপিও শ্যামল মণ্ডল। তদন্তে জানা যায়, গত ৬ তারিখ ছোট্ট মেয়ে, স্ত্রী সোনালি ও শ্যালক সাহিলকে সঙ্গে নিয়ে ডায়মন্ড হারবারের ভাড়া বাড়িতে আসেন নির্মল। তিনদিন পর তাঁর দেহ মেলে নর্দমায়। তদন্তে নেমে সোনালি ও সাহিলকে আটক করে দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে পুলিশ। ময়নাতদন্তে শ্বাসরোধ করে খুনের প্রমাণ মেলার পর থেকেই সোনালির প্রতি সন্দেহ গাঢ় হতে থাকে তদন্তকারী অফিসারের। তার মোবাইলের কল লিস্ট খতিয়ে দেখে পুলিশ জানতে পারে, চলতি মাসের পয়লা তারিখ থেকে একটি নম্বরে দিনে একাধিকবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা হয়েছিল সোনালির। সাহিলই পুলিশকে জানায় সেই নম্বরটি আরশাদের। বিয়ের আগে দিদির সঙ্গে আরশাদের যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, সেটাও সাহিল পুলিশকে জানিয়ে দেন।
আরশাদের ফোনের টাওয়ার লোকেশান ইকবালপুরে মেলায় পুলিশ আরও নিশ্চিত হয়। বৃহস্পতিবার দিনভর টানা জেরায় প্রেমিক আরশাদ জলিলের সঙ্গে পরিকল্পনা করে স্বামীকে খুনের কথা সোনালি স্বীকার করে নেয় বলে পুলিশের দাবি। এর পরই রাতে ইকবালপুরে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে ভগ্নিপতির বাড়ি থেকে আরশাদকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আরশাদও পুলিশি জেরায় ভেঙে পড়ে খুনের কথা স্বীকার করে নেয় বলে পুলিশ জানিয়েছে। গত রবিবার রাতে ১২ নম্বর ওয়ার্ডের রায়নগর এলাকায় ভাড়া বাড়িতে ঢুকে নির্মলকে শ্বাসরোধ করে খুনের পর দেহ তুলে নিয়ে বাড়ির পাশের ড্রেনে দেহ ফেলে রেখে চম্পট দিয়েছিল আরশাদ। রহস্যের জট খুলতে হাল ছাড়েননি তদন্তকারী অফিসার সন্দীপ পাল। শীঘ্রই ধৃতদের নিয়ে ঘটনার পুনর্নির্মাণ করা হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। ডায়মন্ড হারবার পুলিশ জেলার সুপার ভোলানাথ পাণ্ডে বলেন, ‘খুবই নিখুঁত ভাবে ছক সাজিয়ে ক্রাইমটা করা হয়েছিল। তদন্তে সমস্ত তথ্য উঠে আসায় দু’জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এটা পুলিশের বড়সড় সাফল্য।’
পুলিশ সূত্রের খবর, বছর তিনেক আগে সম্বন্ধ করেই রেলকর্মী নির্মলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল বিহারের মুঙ্গের জেলার হাবেলি খড়্গপুর এলাকার বাসিন্দা সোনালি কুমারীর। বিয়ের আগে সোনালির সঙ্গে পাশের গ্রাম মনসুরটোলার বাসিন্দা আরশাদের যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল, তা জানতে পারেননি ভাগলপুর জেলার সুলতানগঞ্জ এলাকার আবজুগঞ্জের বাসিন্দা নির্মলের পরিবার। বিয়ের কয়েকমাস আগে রেলের চাকরি পেয়েছিলেন নির্মল। বছর দেড়েক আগে ডায়মন্ড হারবারের স্টেশন মাস্টার হয়ে আসেন তিনি। তার পর থেকে ডায়মন্ড হারবারে ভাড়া বাড়িতে একাই থাকতেন। বিয়ের মাস ছয়েক পর আচমকা একদিন সোনালি বাপের বাড়িতে গিয়ে ওঠে। আর কখনও শ্বশুরবাড়িতে ফেরেনি সে। ছুটিতে নির্মল শ্বশুরবাড়িতে স্ত্রীর কাছে যেতেন।
কিন্তু প্রেমিক আরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করেননি সোনালি। আরশাদ দুবাইয়ে চাকরি করলেও সোনালির টানে চাকরি ছেড়ে কয়েকমাস আগে বাড়িতে ফিরে আসে। তার পর থেকে প্রায়শই সকলের চোখ এড়িয়ে দু’জন আলাদা রাত কাটাত বলে তদন্তে জেনেছে পুলিশ। ছটপুজোয় নির্মল বাড়িতে গেলে ডায়মন্ড হারবারে বেড়াতে আসার জন্য জেদ ধরে সোনালি। স্ত্রীকে নিয়ে নির্মল ভাড়াবাড়িতে আসার পর পরিকল্পনা মাফিক ৯ তারিখ সকালে আরশাদও ইকবালপুরে ভগ্নিপতির বাড়িতে ওঠে। সকালে সোনালির সঙ্গে ফোনে কথা হওয়ার পর ওই দিন বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করার জন্য আরশাদ চলে আসে ডায়মন্ড হারবারে। জানালা দিয়ে সোনালি রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রেমিক আরশাদের সঙ্গে কথাও বলে। সে সময়ই পথের কাঁটা স্বামীকে সরানোর জন্য সে আরশাদের কাছে জেদ ধরে বলে ধৃতদের জেরা করে জানতে পেরেছে পুলিশ।
নির্মলের ভাড়া বাড়ি ও রাস্তাঘাট দেখে ওই দিন রাতে আরশাদ ফিরে যায় ইকবালপুরে। ১০ তারিখ বিকেলে সে ফের ডায়মন্ড হারবারে চলে আসে। তা জানত সোনালিও। বাড়ির আশেপাশেই ঘোরাঘুরি করে আরশাদ। সন্ধে নাগাদ ভাড়াবাড়ি থেকে বাজারে যাওয়ার পথে নির্মল ও সাহিলের পিছুও নিয়েছিল সে। কিন্তু রাস্তায় লোকজনের ভিড় থাকায় কিছু করতে পারেনি। রাতে খাওয়ার পর ঘুমোতে গিয়েছিল সকলে। কিন্তু রাতে মেয়েকে নিয়ে পাশের ঘরে একাই শুয়েছিল সোনালি। নির্মল পাশের ঘরে একাই ছিলে। আর একটি ঘরে ছিলেন সাহিল। রাতে ভাড়া বাড়ির সামনের সমস্ত দরজা বন্ধ করে পিছনের দরজা খুলে রেখেছিল সোনালি। সেই দরজা দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে নির্মলকে শ্বাসরোধ করে খুন করে সে।
তাদের ধস্তাধস্তির শব্দ ভাই সাহিল যাতে শুনতে না পায়, সে জন্য রাতে মেয়েকে নিয়ে ভাই সাহিলের ঘরে যায় সোনালি। যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে সে জন্য ভাইয়ের কাছে মেয়েকে শুইয়ে রেখে রান্নাঘরে দুধ গরম করতে যাওয়ার ভান করে সে। ভাগ্নির কান্নায় পাশের ঘরে জামাইবাবুকে খুনের ঘটনা টের পায়নি শ্যালক। খুনের পর আরশাদ ঘর থেকে নির্মলের দেহ তুলে নিয়ে বাড়ির পাশের ড্রেনে ফেলে রেখে চম্পট দিয়েছিল। কিন্তু শেষরক্ষা হল না। এ দিন কান্নায় ভেঙে পড়ে নির্মলের ভাই বিদ্যাসাগর বলেন, ‘বৌদিকে অন্ধের মতো ভালোবাসত দাদা। আমরাও বুঝতে পারিনি বিয়ের আগে বৌদির সঙ্গে পরপুরুষের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। দাদাকে ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে এ ভাবে ছক কষে বৌদি ও তার প্রেমিক খুন করবে, ভাবতেই পারছি না। ওদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’